:: চপল মাহমুদ ::
চার স্তম্ভের ওপর দাঁড়ানো বাংলাদেশের অর্থনীতি করোনাকালে সবই সংকটের মুখে পড়েছে। তবে কেবল কৃষি ও কৃষকই বাঁচিয়ে রেখেছে-এমনটি অর্থনীতিবিদদের ধারণা। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপর দায়মান । বাজেটে কৃষিকে বাড়তি অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
এ খাতের বরাদ্দ ৪ শতাংশ বাড়িয়ে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে সোয়া ৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী অধিবেশনে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ১১ জুন সংসদে উপস্থাপিত আগামী অর্থবছরের বাজেট। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিকে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ অগ্রাধিকার। বাজেটে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দ বা এডিপির চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ৪ শতাংশ বাড়িয়ে কৃষি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ বাজেটের দেড় শতাংশ।
এ ছাড়া বাজেটে খাদ্য ও কৃষিতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা থাকছে ১৫ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের চেয়ে ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা বেশি। বাজেটে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সর্বোচ্চ বরাদ্দের তালিকায় শীর্ষ ১০-এ নেই কৃষি। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে কৃষি খাতও করোনায় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাজেট হবে সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে। কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষি ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বাড়তি নজর থাকছে বাজেটে।
করোনা ভাইরাস-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া হবে এবারের বাজেটে। কৃষিতে অগ্রাধিকারের কথা বলা হলেও এডিপির আকার অনুযায়ী ৪ শতাংশ বরাদ্দ থাকছে। এ ছাড়াও ভর্তুকি হিসেবে থাকছে ৯ হাজার কোটি টাকা-সংকট মোকাবিলায় যা পর্যাপ্ত বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী। কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষিতে ভর্তুকি ও বরাদ্দ যথেষ্ট থাকলেও তার গুণগত ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়েনি। ডেটাবেজের কারণে অনেক প্রান্তিক কৃষকও বঞ্চিত হন ঋণ সুবিধা থেকে।
কৃষি বাজেট নিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক জানান, এমনিতেই সব সময় কৃষি খাতে বাজেট একটু বেশিই থাকে। এর মধ্যে এ বছর বেশি গুরুত্ব দেব বিশেষ করে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। তাই এবারের বাজেটে আরও দুটি কর্মসূচি আমাদের আছে, যা সম্পৃক্ত বা উল্লেখ হয়নি। সেটা প্রক্রিয়াধীন আছে। আমরা কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য একটি প্রকল্প দিয়েছি, সেটি বাজেটে সম্পৃক্ত হবে। বরাদ্দ হবে ৩ হাজার ২ শত কোটি টাকা।
এছাড়া আরও নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। আমরা সেগুলোর ওপর কাজ করছি, যা ৪ শতাংশ না, আরও বেশি হবে। কৃষিমন্ত্রী বলেন, করোনা মহামারীকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে সেদিকে দৃষ্টি রেখে বিশেষ প্রণোদনা রাখা হবে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলছে, করোনার প্রভাবে বড় দুর্ভিক্ষের শঙ্কা রয়েছে। এতে তিন কোটি মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। তাই আগামীতে যেন খাদ্যের কোনো সংকট না হয়, সে জন্য সরকারি গুদামে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি খাদ্যশস্য মজুদ করছে সরকার। পাশাপাশি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে খাদ্য ও কৃষিতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১৫ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের চেয়ে ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা বেশি। এছাড়া ৪ শতাংশ রেয়াদি সুদে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ ঋণ জামানত ছাড়া কৃষিকাজে সরাসরি নিয়োজিত প্রকৃত কৃষক, ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, বর্গাচাষিসহ অন্যদের ফসল বন্ধীকরণ চুক্তির মাধ্যমে প্রদান করা হবে। এ ছাড়া ফুল, ফল, মৎস্য চাষ ও পোলট্রি খাতে ৪ শতাংশ সুদে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা বিশেষ প্রণোদনা স্কিম গঠন করা হয়েছে। ফলে কৃষি খাতে মোট ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণপ্রবাহ সৃষ্টি হবে। এ ঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে করোনা ও আম্পানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে দেশের কৃষি খাত।
আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সামনে রেখে কৃষি ও কৃষকের জন্য করণীয় বিষয়ে সাংবাদিক শাইখ সিরাজ বিডি নিউজ বুক টোয়েন্টিফোর ডট নেটকে বলেন, কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর জন্য জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ, কর্মহীন বেকারদের কৃষিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জরুরি সহায়তা প্রকল্প, শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের উদ্যোগ গ্রহণ উপযোগী কৃষি সহায়তা প্রকল্প, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি সহায়তা প্রকল্প চালু করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি মাশরুম চাষ সম্প্রসারণে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দান, আধুনিক গ্রিন হাউস ও পলিনেট হাউসে কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পে সহায়তা দান ও ছোট পরিসরে বায়োফ্লক, রাস ও রেসওয়ে পদ্ধতির মাছ চাষ প্রকল্পে সহায়তা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান ও নতুন সৃষ্ট, দারিদ্র্য উত্তরণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট বাজেটের ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার দাবি করেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বিডি নিউজ বুক টোয়েন্টিফোর ডট নেটকে বলেন, ‘কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে যে ইনোভেশনগুলো এসেছে সেগুলোকে সম্প্রসারণ করতে হবে। সেই সাথে সরকার প্রণোদনা দিয়ে অনলাইন কৃষিবাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। সরকারকে কৃষি মার্কেটিংয়ে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।’
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ বিডি নিউজ বুক টোয়েন্টিফোর ডট নেটকে বলেন, ‘দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান এবং সেই অনুযায়ী কৃষকের বঞ্চিত হওয়ার ব্যাপারটি তুলে ধরে সঙ্কট মোকাবিলায় কৃষকের হাতে নগদ অর্থ প্রদান করতে হবে। তা না হলে কৃষক সময়মতো বীজ, সার, অন্যান্য জিনিস কিনতে পারবে না। বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। ভোক্তা ও উৎপাদকের মধ্যে সরাসরি সংযোগের ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। তার মাধ্যমে দুজনেই সঠিক মূল্য অর্জন করতে পারবে।’
Leave a Reply